• ঢাকা
  • শনিবার , ২৭ এপ্রিল ২০২৪ , রাত ০৯:১৪
ব্রেকিং নিউজ
হোম / জাতীয়

কুড়িগ্রামে ব্যতিক্রমধর্মী বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর

রিপোর্টার : নিজস্ব প্রতিবেদক
কুড়িগ্রামে ব্যতিক্রমধর্মী বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর প্রিন্ট ভিউ

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-

কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর পারে বড়ভিটা গ্রামে গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী এক জাদুঘর। নাম বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর। লেখক ও স্কুল শিক্ষক তৌহিদুল ইসলামের হাত ধরে গড়ে ওঠা জাদুঘরটি বিরল পত্রিকা আর বইয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্রমেই।

কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ধরলা নদীর তীরে বাংটুর ঘাট। সেই ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় নদী পার হয়ে মোটরসাইকেলযোগে কিছুদূর গেলে দেখা যাবে সড়কের পাশেই জাদুঘর। কয়েক কদম এগোতেই দেখা হলো জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক।

শিশু সাহিত্যিক ও গীতিকার হিসেবেও সুনাম রয়েছে। এ পর্যন্ত ১৭টি শিশুতোষ গ্রন্থ লিখেছেন। জানালেন, গত বছর পাঠাগার সংগঠক হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা ও পুরস্কার হিসেবে পান দুই লাখ টাকা। তিনি ভেবে দেখেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো সমৃদ্ধ জাদুঘর গড়ে ওঠেনি, যদিও ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি প্রথম লেখক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে।

ভাবলেন, নিজেই লেখক জাদুঘর গড়ে তুলবেন। সেই ভাবনারই ফসল বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর।  নিজ বাড়ির আঙিনায় একটি টিনশেড ঘরে পুরস্কারের টাকায় গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে জাদুঘরটি। উদ্বোধন করেন লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক।

ছোট্ট এই জাদুঘরের পাঁচটি গ্যালারিজুড়ে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই শতাধিক কবি ও লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত ছবি। বাংলা সাহিত্য ও বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য বিলুপ্ত পত্রপত্রিকাও আছে। এই জাদুঘরে দেখা মিলবে ১৪০ বছর আগে ১২৮৯ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকা। বিখ্যাত ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসটি প্রথম ধারাবাহিকভাবে ছাপানো হয় যে সংখ্যায়, সেটিও আছে। রয়েছে ১৩২১ সালের প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকা সবুজ পত্র।

মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত ১৯৩৬ সালের মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা। সুবোধচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ১৯৬৩ সালের নব কল্লোলের ফাল্গুন সংখ্যাও আছে। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ১৯৬১ সালের সমকালও আছে। এটি রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা। পূবালী, বেগম পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা আছে। আছে পাকিস্তান আমলের বেশ কয়েকটি পত্রিকা। ১৯৬৮ সালের রবীন্দ্র ভারতী, ১৯৬৯ সালের বিশ্বভারতী এবং ১৯৭০ সালের কবীর চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি পত্রিকাও পাবেন। ১৯৬৫ সালের উল্টোরথ পত্রিকা এবং গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ১৯৬৮ সালের সচিত্র সন্ধানী পত্রিকাও রয়েছে। একুশের সংকলন রয়েছে বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালের হাবীবুল্লাহ সিরাজী সম্পাদিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সংকলন ‘প্রদাহ’ আছে।

যুদ্ধ ও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের স্মারকও মিলবে এখানে। ১৯৬৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের দৈনিক পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম ‘সারারাত্রি লড়াই : পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক কয়েকটি ঘাঁটি পুনর্দখল’।

১৯৭০ সালের ১৮ নভেম্বরের দৈনিক সংবাদ রয়েছে। সেখানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দিয়ে শিরোনাম, ‘কেবল ভোলাতেই দুই লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু’। ২০ মার্চ ১৯৭১ দৈনিক পূর্বদেশে আছে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক নিয়ে শিরোনাম। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশে প্রথম সফর উপলক্ষে দৈনিক পূর্বদেশের বিশেষ সংখ্যা রয়েছে এই সংগ্রহশালায়।

তৌহিদুল ইসলাম জানান, জাদুঘর প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই তিনি কিছু সোর্স তৈরি করেছেন সারা দেশে। দুর্লভ পত্রপত্রিকা ও বইয়ের হদিস পেয়ে যাঁরা যোগাযোগ করেন তৌহিদুলের সঙ্গে। এরপর জাদুঘরে ঠাঁই হয় এসব মূল্যবান পত্রিকা ও বইয়ের মূলকপি। একেকটি পত্রিকা বা বই আট হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায়ও কিনেছেন। সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বা ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনাসমৃদ্ধ পত্রিকা বা প্রখ্যাত লেখকের বইয়ের দুর্লভ কপি সংগ্রহে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

জাদুঘর বড় হচ্ছে। বড় হচ্ছে তৌহিদুল ইসলামের স্বপ্নও। জানালেন, বাড়ির সামনে পাঠাগারের পাশে যে ১০ শতক জমি রয়েছে, তা জাদুঘরের নামে দান করবেন। এরপর সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় জাদুঘরের দ্বিতল ভবন নির্মিত হবে। ছয় বছর পর যখন অবসরে যাবেন, তখন যে টাকা পাবেন, সেই টাকা ব্যয় করবেন জাদুঘর সমৃদ্ধ করার কাজে।

জাদুঘরের পাশেই রয়েছে সৈয়দ শামসুল হক মঞ্চ। আর সামনেই তৌহিদুল ইসলাম নিজ নামে গড়ে তুলছেন ‘গীতিকার তৌহিদুল ইসলাম পাঠাগার’। রয়েছে সৈয়দ শামসুল হক কালচারাল ক্লাব। নিজের ৪ শতক জমি এসব প্রতিষ্ঠানের নামে দান করে মনোরম পরিবেশে চালিয়ে যাচ্ছেন সংগীত, আবৃত্তি, বই পড়াসহ নানা কার্যক্রম। প্রতিবছর ২৭ ডিসেম্বর লেখক সৈয়দ হকের জন্মদিনে সৈয়দ শামসুল হক শিশু পুরস্কার প্রবর্তন করেছেন তিন বছর হলো। পুরস্কারের অর্থমূল্য ২০ হাজার টাকা।

তৌহিদুল জানালেন, পাঠাগারে পাঁচ শতাধিক নিয়মিত পাঠক রয়েছে। বছরে প্রায় এক হাজার বই আদান-প্রদান হয়। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের মাধ্যমেও কয়েকটি স্কুলে নিয়মিত চালান বইপাঠ কার্যক্রম। সব কাজে তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান সমর্থন দেন। আগামী দিনে এসব কার্যক্রম আরো বিস্তৃত করতে চান তৌহিদুল।

জাতীয়

সারাদেশ

আরও পড়ুন